আনোয়ারুল করিম, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: সৌদি আরবের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে শিরচ্ছেদ হওয়া ৮ বাংলাদেশি নাগরিকের পরিচয় জানা গেছে।
বাংলানিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে সৌদি আরবের রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে এদের ঠিকানা নিশ্চিত করা হয়।
রিয়াদ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর হারুন অর রশিদ শনিবার বিকেলে বাংলানিউজকে জানান, শিরচ্ছেদ হওয়া বাংলাদেশিরা কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা।
কাউন্সেলর হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, শুক্রবার বিকেলে আসরের নামাজের পর স্থানীয় আইন অনুযায়ী প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদের মাধ্যমে এদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দণ্ডের বিধান অনুযায়ী, তাদের লাশ সৌদি আরবেই দাফন করা হয়েছে। লাশ দেশে আনা যাবে কীনা তাও নিশ্চিত নয়; তবে চেষ্টা করা হচ্ছে।‘
কাউন্সেলর বাংলানিউজকে বলেন, ‘সৌদি আরবের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ এবং উচ্চতর উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোনক্রমে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে মিশরীয় নাগরিক হাসান আল সাইদকে হত্যার দায়ে ওই ৮ বাংলাদেশিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।’
বাংলানিউজ নিশ্চিত হয়েছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার কামারপুর গ্রামের মিলন মিয়ার পুত্র সুমন মিয়া।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পূর্বশুভা গ্রামের আব্দুল হাইয়ের পুত্র সুমন।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পূর্বশুভা গ্রামের (ডাকঘর: কস্তুরিপাড়া) শামসুল হকের পুত্র মাসুদ।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আব্দুল্লাহপাড়া গ্রামের (ডাকঘর: চৌবাড়ি) আব্দুল মান্নান সরকারের পুত্র মামুন।
টাঙ্গাইলের সফিপুর উপজেলার ভাতকুরার চালা গ্রামের (ডাকঘর: হতেয়া রাজবাড়ি) খোয়াজউদ্দিনের পুত্র শফিকুল ইসলাম।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার পইয়াকান্দি গ্রামের জামালউদ্দিনের পুত্র ফারুক।
ফরিদপুরের আহম্মদ বিশ্বাসের পুত্র আবুল হোসেন।
ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণনগর গ্রামের শহিদ খানের পুত্র মতিয়ার রহমান।
লাশ সৌদিতেই দাফন: দণ্ডিত ব্যক্তিদের লাশ সৌদি আরবেই দাফন করা হয়েছে বলে বাংলানিউজকে জানান কাউন্সেলর হারুন অর রশিদ।
তিনি বলেন, ‘সৌদি কর্তৃপক্ষ কোনও বিদেশী নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে অবহিত করে না।’
কাউন্সেলর বলেন, ‘দণ্ড কার্যকর এবং মৃতদেহ স্থানীয়ভাবে দাফনের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দণ্ড কার্যকর ও গৃহীত ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে অবহিত করা হয়।’
কাউন্সেলর বাংলানিউজকে বলেন, ‘স্থানীয় রীতি মোতাবেক আমরাও দণ্ড কার্যকর সম্পর্কে আগে কোনও তথ্য পাইনি। তবে রিয়াদ কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাদের শুভানুধ্যায়ীদের মাধ্যমে আমরা শুক্রবার সন্ধ্যায় রায় কার্যকরের বিষয়টি অবহিত হই।’
বাংলাদেশিদের লাশ দেশে ফেরত প্রসঙ্গে কাউন্সেলর বাংলানিউজকে জানান, স্থানীয় রীতি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া ব্যক্তিদের মৃতদেহ স্থানীয় পুলিশের ব্যবস্থাপনায় স্থানীয়ভাবে দাফন করা হয়। এসব মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানো যায় কিনা সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলেও বাংলানিউজকে জানান তিনি।
৮ জন যা করেছিলেন: দণ্ডিত ৮ জনের অপরাধ সম্পর্কে শ্রম কাউন্সেলর বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া ৮ বাংলাদেশিসহ মোট ১১ জন বাংলাদেশি ২০০৭ সালের ২২ এপ্রিল রিয়াদে এক গুদাম থেকে বৈদ্যুতিক তার চুরির সময় সে গুদামের মিশরীয় গার্ড হাসান আল সাইদ-কে হত্যা করে। অভিযুক্তরা আদালতে তাদের এ কাজের কথা স্বীকারও করেন।’ তিনি বাংলানিউজকে আরও বলেন, ‘আসামীদের স্বীকারোক্তি ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী বিচার করে আসামিদের বিরুদ্ধে ‘ডাকাতি, নরহত্যা এবং জমিনে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিচারিক আদালত এই ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য তিন জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও বেত্রাঘাতের দণ্ড প্রদান করে।’ দূতাবাস যা করেছে: ঘটনার পর মামলা সম্পর্কে অবহিত হয়ে দূতাবাস থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয় বলে দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর বাংলানিউজকে জানান।হারুন অর রশিদ বলেন, ‘মামলার বিস্তারিত বিবরণ প্রদান এবং দন্ডপ্রাপ্তদের সাথে কথা বলার জন্য কনসুল্যার আকসেস চেয়ে দূতাবাস থেকে ২০০৮ সালের জুন মাসে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েক দফা নোট ভারবাল পাঠানো হয়। তিনি বাংলানিউজকে আরও বলেন, ‘২০০৮ সালের অক্টোবরে প্রথমবারের মতো কনস্যুলার অ্যাকসেস পেয়ে দূতাবাস থেকে আমি আল হায়ের কারাগারে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের সঙ্গে সাক্ষাত করি এবং দূতাবাসের পক্ষ থেকে আইনী সহায়তার ব্যবস্থা করি।’‘এরপর থেকে শুরু করে গত সপ্তাহ পর্যন্ত দূতাবাসের কর্মকর্তা ও আইন সহকারীরা আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় অসংখ্যবার আসামীদের সাথে জেলখানায় সাক্ষাত করেছেন’ কাউন্সেলর বাংলানিউজকে বলেন। ক্ষমা করতে সৌদি বাদশাহকে রাষ্ট্রপতির চিঠি: কাউন্সেলর হারুন অর রশিদ আরও জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনী কার্যক্রম চলাকালে সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ক্ষমা করার জন্য সৌদি আরবের মহামান্য বাদশাহ’র কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির চিঠির বিষয়ে স্থানীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদেরকে জানান যে, পবিত্র কোরানের বিধান অনুযায়ী হত্যাকান্ডের জন্য দণ্ডপ্রাপ্তদের ক্ষমা প্রদানের এখতিয়ার রয়েছে কেবলমাত্র নিহতের পরিবারের।’‘সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের জানায়, শরীয়াহ আইন অনুযায়ী হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কেবলমাত্র নিহতের পরিবার এ দণ্ড ক্ষমা করতে পারে’ হারুন অর রশিদ বলেন বাংলানিউজকে।কাউন্সেলর আরও বলেন, ‘এরপর নিহত মিশরীয়র পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়।’ ক্ষমা করেনি নিহতের পরিবার: রিয়াদ দূতাবাসের লেবার কাউন্সেলর হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, নিহত হওয়া মিশরীয় ব্যক্তির পরিবার বাংলাদেশিদের ক্ষমা করতে রাজি হয়নি।’ রিয়াদস্থ মিশরীয় দূতাবাসের মাধ্যমে নিহত হাসান আল সাইদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে দণ্ডপ্রাপ্তদের ক্ষমা করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় বলেও বাংলানিউজকে জানান হারুন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াদস্থ মিশরীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান।’কাউন্সেলর বলেন, ‘তখন মিশরের রাষ্ট্রদূত আমাদের রাষ্ট্রদূতকে জানান যে, নিহত হাসান আল সাইদ মিশরের প্রত্যন্ত জনপদ শারকাইয়া এলাকার অধিবাসী। ওই এলাকার অধিবাসীরা সাধারণভাবে হত্যার বদলে হত্যার নীতি একনিষ্ঠভাবে বিশ্বাস করেন।’ ‘মিশরীয় রাষ্ট্রদূত আমাদের আরও জানান, এ কারনে নিহত হাসান আল সাইদ-এর উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে প্রাণভিক্ষার সম্মতি আদায় করা একটি কঠিন কাজ। তবে তিনি নিহতের পরিবারকে যেকোনওভাবে দণ্ডপ্রাপ্তদের ক্ষমা করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আশ্বাস প্রদান করেন। এ ব্যাপারে রিয়াদস্থ মিশরীয় দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়,’ বাংলানিউজকে বলেন কাউন্সেলর।কাউন্সেলর হারুন বলেন, ‘তবে দুই বছর আগে মিশরীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়ে দেন যে, নিহতের পরিবার কোনওভাবেই হত্যাকারীদের ক্ষমা করতে রাজি নয়।’ ‘ব্লাড মানি’ (ক্ষতিপূরণ) দিয়ে পরিবার দণ্ডপ্রাপ্তদের ক্ষমা করার জন্য মিশরীয় দূতাবাসের মাধ্যমে প্রস্তাব দেওয়া হলেও নিহত হাসান আল সাইদের পরিবার সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি বলেও বাংলানিউজকে জানান কাউন্সেলর হারুন।রায় কার্যকরের চূড়ান্ত পদক্ষেপ: কাউন্সেলর হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে জানান, ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, আদালতের রায় কার্যকর করার ছাড়পত্র চেয়ে মামলার নথি এ সংক্রান্ত উচ্চতর উপদেষ্টা পরিষদে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ সংবাদ জানার পর আমরা স্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে বিভিন্ন মানবিক বিষয় উল্লেখ করে এবং ক্ষমা সংক্রান্ত পবিত্র কোরআনের বিধান বর্ণনা করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মৃত্যুর দণ্ড মওকুফ করার জন্য একটি আবেদনপত্র প্রস্তুত করি।’তিনি বাংলানিউজকে আরও বলেন, ‘জেলখানায় গিয়ে দণ্ডপ্রাপ্তদের সাথে সাক্ষাত করে তাদের কাছ থেকে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর নেয়া হয়। পরে জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদপত্রটি আপীল কোর্ট ও উচ্চতর উপদেষ্টা পরিষদে প্রেরণ করা হয়।’তবে তাতেও কোনও কাজ হয়নি, কারণ মিশরীয় ওই পরিবার তো আর ক্ষমা করতে রাজি হয়নি। তাই সৌদি কর্তৃপক্ষও তাদের রায় কার্যকরের উদ্যোগ বন্ধ করেনি। শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হয়েছে, বাংলানিউজের কাছে মন্তব্য কাউন্সেলর হারুন অর রশিদের।
No comments:
Post a Comment